ফেসবুক কর্ণারঃ
শেষমেশ পা-টা মচকেই গেল। বেচারা পায়েরই বা কী দোষ। প্রায় সত্তুর কেজির কাছাকাছি ওজনের একটি খানদানি শরীরকে আর কাঁহাতক বহন করা যায়? তাও আবার শুধুইকি বহন করা? অনেকটা লিফটের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে প্রায় দুই মণি শরীরটাকে কখনও দোতলায় আবার কখনোবা তিনতলায় বয়ে নিয়ে যাওয়া কি চাট্টিখানি কথা? ছোটবেলা থেকেই ময়-মুরুব্বীরা সমানে উপদেশ দিয়ে গেছেন- খবরদার, ভাঙবি কিন্তু মচকাবিনা। বড় হওয়ার পরে বিভিন্ন গল্প উপন্যাস থেকে শুরু করে বাস্তব উপলব্ধি থেকেও সবল মানুষের মূল সংজ্ঞা জেনেছি একটাই, সেটা হলো – ভাঙবি তবু মচকাবিনা। চোখের সামনে অনেকেই কত সহজেই ফটাফট ভেঙ্গে গেল। এক ভাগনে তো হাত- পা ভেঙ্গে বিছানায় পড়ে ছিল মাস দুয়েক। দুই ভাইতো (একজন অগ্রজ, অপরজন অনুজ) এই ভাঙ্গার কাজটা সেই ছোটবেলাতেই সেরে ফেলেছে। আরেক ছোট ভাই যে কিনা বেশ হোমড়াচোমরা ধরনের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা, কিছুদিন আগে কত অবলীলায় না বাম পাটা ভেঙ্গে ফেললো। একেবারে গোড়ালির কাছাকাছি দু’টুকরো। প্রায় সপ্তাহ তিনেক বিছানাও নিতে হয়েছে। ঐ ভাগনেটার মতো ওরও অপারেশন করতে হয়েছে। ক্রিকেট খেলতে গিয়ে আমার বড় ছেলেটার বাম হাত ভেঙ্গে গিয়েছিল বছর তিনেক আগে। যার কারণে ওকে বাম হাতের কাজও ডানহাতে করতে হয়েছে। এতো কিছুর পরেও ওরা সবাই বীর পুরুষ। কারণ ওরা ভেঙ্গেছে কিন্তু মচকায়নি। আর বেচারা আমি? ঝলমলে শৈশব পেরিয়ে কৈশোর, ছটপটে কৈশোরের সীমানা ডিঙ্গিয়ে যৌবন, আর ভরা যৌবনের স্রোতে গা ভাসিয়ে মধ্য বয়সে পা রেখেছি। আর এই হারামজাদা পা কিনা আমার সাথে বিট্রে করলো? না হয় ভেঙ্গেই যেতি। তাতে হয়তো বা বিছানায় পড়ে থাকতে হতো দিন – সপ্তাহ কিংবা মাসখানেক। তবু্ও তো প্রেস্টিজটা বজায় থাকতো। লোকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলতো- সাবাশ! ভাঙ্গবি তবুও মচকাবিনা। কিন্তু আমার ভাগ্য সম্পর্কে পূর্নেন্দু পত্রীর পংক্তিটাই যথার্থ-আমার ভাগ্যটা হচ্ছে- “ঘোলা জলের ডোবা”। নইলে আমার মতো এরকম একটা খানদানি শরীরকে বহন করার সুযোগ পেয়েও খতরনাক ডান পা এরকম একটি ছোটলোকি স্বভাবের পরিচয় দিল? কোনোরূপ পূর্বাভাস না দিয়েই ব্যাটা মচকে গেলো?
বেচারা পা! পূর্বাভাস দেবেই বা কী করে? আমি নিজেও কি জানতাম এমনটা ঘটবে? ডান পায়ের উপর দিয়ে একটা আস্ত রিকশা চলে যাবে সেটা কি আমি ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পেরেছিলাম। আর ঐ রিকশার উপর তখন বসা ছিল আমার অর্ধাঙ্গিনী (অর্ধাঙ্গিনী শুনে আবার এটা ভেবে বসবেন না যে ওর ওজন মাত্র পয়ত্রিশ কেজি) এবং জৈষ্ঠ্য পুত্র (ওজনের দিক দিয়ে যে কিনা আমার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী)। সেদিন পায়ের ঝালটা রিকশাওয়ালার উপর দিয়েই ঝাড়া ছাড়া আমার আর কিছুই করার ছিলনা। মাস্টারি কায়দায় উপদেশ ও ধমক দুটোই রিকশাওয়ালার উপর বিতরণ করার পরেও কিছুতেই পদস্খলন ঠেকাতে পারলামনা।
ডান পায়ের এই মচকে যাওয়ার বিষয়টি চেপে যাওয়ার চেষ্টা চালাতে লাগলাম। বেশ একটা রিনরিনে ব্যথা খতরনাক পায়ের হাঁটুর নিচটা দখল করে থাকলো। করুক দখল। আগেতো প্রেস্টিজ। মচকে যাওয়ার কথা কিছুতেই কাউকে বলা যাবে না। কিন্তু বিপত্তি আমার পিছু ছাড়লো না। আমার এক বন্ধুপ্রতিম কলিগ গলায় বেশ খানিকটা মমতা নিয়ে জানতে চাইলেন-
“আহ্হারে, পা টা মচকে গেছে বুঝি?”-গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেলো আমার। প্রেস্টিজ বলে বুঝি আর কিছুই থাকলো না! একেই বুঝি বলে প্রেস্টিজ পাংচার। মচকানো পা টাকে টেনে নিয়ে সেটার উপর সটান দাঁড়িয়ে গেলাম। মুখে আনন্দের ফুলঝুরি ছুটিয়ে তাকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলাম-
” আরে না না, অনেকক্ষণ বসে ছিলাম তো তাই পায়ে ঝিঁ ঝিঁ ধরে গেছে।”
করিম সাহেব একবার আমার দিকে একবার আমার পায়ের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন। স্বাভাবিক মানুষের মতোই হেঁটে অফিসে ঢুকে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। জুতোজোড়া খুলে পাগুলোকে স্বাধীন করে দিতেই পূরণ হয়ে গেলো সর্বনাশের ষোলকলা। কোনোরকম পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই মচকানো পায়ের উপরিভাগ বেশ স্বাস্থ্যবান হয়ে গেলো। রিনরিনে ব্যথাটার মাঝেও বেশ একটা চনমনে ভাব এসে গেল। আর এমন সময় এলো কিনা বসের ফোন! দেখা করতে বলেছেন। বিষয়টা জরুরী। তড়িঘড়ি করে পা ঢুকাতে গিয়ে ভড়কে গেলাম। কিছুতেই ঐ পাটা জুতোর ভেতর ঢুকছেনা। জোর খাটাতে গিয়ে প্রচন্ড ব্যথায় চোখে জল এসে গেল। ভাগ্যিস বাথরুমে যাওয়ার জন্য অফিসের এক কোনায় একজোড়া চপ্পল ছিল। সেটাই কোনোমতে পায়ে গলিয়ে বসের রুমে উঁকি দিলাম। আমাকে দেখে বস একেবারে হা রে রে করে উঠলেন। চেয়ার ছেড়ে উঠে আমাকে যত্নসহকারে বসিয়ে দিলেন। বসের হাবভাব দেখে আমার আক্কেল গুড়ুম? ব্যাপারটা কী?
“করিম সাহেবের কাছে শুনলাম আপনার নাকি পায়ে সমস্যা হয়েছে? আপনি নাকি পা টেনে টেনে হাঁটছেন?
করিম সাহেবের উপর রাগে গাটা জ্বলে গেল। ওরে আমার দয়ার সাগর! বিনা খরচায় উনি সংবাদ বিলিয়ে বেড়াচ্ছেন! আরে এতই যদি দরদ থাকে তাহলে একটা পা মচকিয়ে দেখাওনা বাপু, দেখে দু’চোখ জুড়াই।
” না না এ তেমন কিছুনা- হাসিতে মুক্তো ঝরে পড়লো আমার।
“কিছুনা বললেই হলো? দেখি আপনার পাটা?- বসের উদ্বেগটা গলায় চাপা থাকেনা।
” না মানে-” কোনটাসা বিড়ালের মতো শেষ চেষ্টা করলাম আমি। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়না। বস রুকুতে যাওয়ার ভঙ্গিতে আমার পায়ের দিকে উনার মূল্যবান দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। বসের দৃষ্টি অনুসরণ করে আমি আমার পায়ের দিকে তাকালাম। পাটাকে এখন বেকারি থেকে আনা তরতাজা পাউরুটির মতো লাগছে। স্বাস্থ্য বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে খোলতাইও বেড়েছে। পায়ের ঐ অংশটুকুকে শরীরের অন্য জায়গার চেয়ে বেশ ফর্সাই লাগছে। বসের অভিজ্ঞ বিচক্ষণ চোখে তা এড়ালো না-
” আরে আরে, আপনার পা তো দেখি মচকে গেছে!- বসের গলায় কেমন যেন একটা চাপা উল্লাস। লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে চাইলাম।
” না না কি যে বলেন? মচকাবে কেন? ঐ একটু- কথা শেষ না করে বেশ একটা তেলতেলে হাসি দেয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু আমার কথায় কান না দিয়ে বসের সরু চোখ সেই পাউরুটি মার্কা পাটার দিকেই।
” হুমম।”- বসের গলার আওয়াজ খানিকটা ডাক্তারদের মতো হয়ে যায়। এমন ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন যেন সবচেয়ে জটিল ডায়াগনোজটা এইমাত্র শেষ করলেন।
” ভালোই মচকে গেছে দেখতে পাচ্ছি। তা হলো কী করে?”- ঘটনার শানে নযুল জানতে চান বস।
এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা আবারও করবো কিনা দ্বিধায় পড়ে গেলাম। মচকে যাওয়ার কথা স্বীকার করলে প্রেস্টিজ তো যাবেই তার উপর শানে নযুল বলতে গেলে অফিসে আর মুখ দেখানোর উপায় থাকবেনা। এদিকে বস রুকু থেকে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। তাঁর জিজ্ঞাসু নেত্র আমার উপর নিবদ্ধ। পাটার দিকে তাকালাম। বেটা খতরনাক পা! খোলতাই আগের চেয়ে আরও বেড়েছে। সাথে বেড়েছে ঐ রিনরিনে ব্যথাটা। বস আবারও শানে নযুল জানতে চাইলেন। উনার তাড়া দেখে মনে হলো আমাকে নয় প্রশ্নটা যেন জাতির বিবেকের কাছেই করা হয়েছে এবং উত্তর জানাটা এই মুহুর্তে জরুরী। এর সাথে অবশ্যই জাতীয় স্বার্থ জড়িত। কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে মুখটা খুলতে গিয়েও পারলাম না কারণ তার আগেই দরজাটা খুলে গেল এবং বসের সুন্দরী পিএ বাতাসা হাইহিল পড়ে গটমট করে ঢুকে পড়লো। ভয়ে মুখ শুকিয়ে আমার আমসি হয়ে গেল। কারণ হাইহিল জিনিসটাকে আমি এমনিতেই প্রচন্ড ভয় পাই। ভার্সিটিতে পড়ার সময় একবার বাসে প্রচন্ড ভীড়ের মাঝে এক মহিলা আমার বাম পায়ের উপর অবলীলায় তার ডান পায়ের হাইহিলটা তুলে দিয়েছিল। আমার আর্তচিৎকার শুনে মেয়েটি তার হাইহিল সরালেও ড্রাইভার তার গাড়িকে সরাতে পারেনি। সোজা তুলে দিয়েছিল পাশের ফুটপাতে। ভাগ্যিস সেখানে হকারদের ওপেন মার্কেট ছিল না। তো বাতাসা ঢুকেই বসের চোখের দৃষ্টি অনুসরণ করে আমার পায়ের দিকে তাকাল। মুহুর্তেই চকচক করে উঠলো ওর চোখজোড়া। একটা পেয়েছি পেয়েছি ভাব তার চোখ-মুখ থেকে ঠিকরে বেরোতে লাগলো।
” বাহ। হাউ নাইস। ফখরুল ভাই। এ জিনিস বানালেন কিভাবে?”
হারামজাদি! মনে মনে একটা কুৎসিত গালি দিলাম। ফাজলামি করার জায়গা পাওনা। জিনিস বানালাম মানে? এখানে জিনিসের কী দেখস? একেই বলে কারো পৌষ মাস কারো সর্বনাশ। রোম বার্নস নিরো ফিডলস। আমি মরি নিজের জ্বালায় আর উনি দিচ্ছেন বাঁশিতে ফুঁ। মুখে আবারও তেলতেলে হাসিটা দিলাম।
” না মানে ঐ গেছে আর কি-”
” মচকে গেছে?”- চট্ করে বসের সাথে দৃষ্টি বিনিময় হয় বাতাসার।- ” ছি ছি ফখরুল ভাই। এ আপনি কী করলেন? পাটা মচকে ফেললেন? তা এটা হলো কীভাবে? – বসের পিএ বলে কথা। বসের মতোই তাগাদা তার কন্ঠে। চট্ করে মুখে কুলুপ এটে ফেললাম। পা মচকে গিয়ে এমনিতেই প্রেস্টিজ পাংচার হয়েছে। পায়ের উপর আমার অর্ধাঙ্গিনী সমেত রিকশা চলে যাওয়ার কথা কিছুতেই বলা চলবেনা। প্রয়োজনে ভাঙ্গবো তবু মচকাবোনা। এই কঠিন সিদ্ধান্তটা নিতে পেরে মনটাই হালকা হয়ে গেলো।
পুনশ্চ : বছর সাতেক আগে পিকনিকে গিয়ে আমার পা মচকে গিয়েছিল। তখন এই গল্পটা লিখেছিলাম। তখন ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারিনি একদিন পা ভেঙে আমাকে বিছানায় পড়ে থাকতে হবে। আজ পাঁচ দিন হয়ে গেল পায়ে ইনজুরি নিয়ে বিছানায় পড়ে আছি। ডাক্তার এক মাসের জন্য বিছানায় পাঠিয়ে দিয়েছেন। শুয়ে বসে দিন কাটাচ্ছি। হঠাৎ করে গল্পটার কথা মনে পড়ে গেলো। তাই পাঠকের জন্য গল্পটি পোস্ট করলাম।

-সোহেল ইকবালের ফেসবুক টাইমলাইন থেকে।